বিচার করিয়ো না। যেখানে তুমি রয়েছ, সে তো জগতে এক কোণা। যেটুকু তব দৃষ্টি যায় সেটুকু কতখানি, যেটুকু শোন তাহার সাথে মিশাও নিজবাণী। মন্দ-ভালো সাদা ও কালো রাখিছ ভাগে ভাগে। সীমানা মিছে আঁকিয়া তোল আপন-রচা দাগে। সুরের বাঁশি যদি তোমার মনের মাঝে থাকে, চলিতে পথে আপন-মনে জাগায়ে দাও তাকে। গানের মাঝে তর্ক নাই, কাজের নাই তাড়া। যাহার খুশি চলিয়া যাবে, যে খুশি দিবে সাড়া। হ'ক-না তারা কেহ-বা ভালো কেহ-বা ভালো নয়, এক পথেরি পথিক তারা লহো এ পরিচয়। বিচার করিয়ো না। হায় রে হায়, সময় যায়, বৃথা এ আলোচনা। ফুলের বনে বেড়ার কোণে হেরো অপরাজিতা আকাশ হতে এনেছে বাণী, মাটির সে যে মিতা। ওই তো ঘাসে আষাঢ়মাসে সবুজে লাগে বান, -- সকল ধরা ভরিয়া দিল সহজ তার দান। আপনা ভুলি সহজ সুখে ভরুক তব হিয়া, পথিক, তব পথের ধন পথেরে যাও দিয়া।
তোমরা রচিলে যারে নানা অলংকারে তারে তো চিনি নে আমি, চেনেন না মোর অন্তর্যামী তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা। বিধাতার সৃষ্টিসীমা তোমাদের দৃষ্টির বাহিরে। কালসমুদ্রের তীরে বিরলে রচেন মূর্তিখানি বিচিত্রিত রহস্যের যবনিকা টানি রূপকার আপন নিভৃতে। বাহির হইতে মিলায়ে আলোক অন্ধকার কেহ এক দেখে তারে, কেহ দেখে আর। খণ্ড খণ্ড রূপ আর ছায়া, আর কল্পনার মায়া, আর মাঝে মাঝে শূন্য, এই নিয়ে পরিচয় গাঁথে অপরিচয়ের ভূমিকাতে। সংসারখেলার কক্ষে তাঁর যে-খেলেনা রচিলেন মূর্তিকার মোরে লয়ে মাটিতে আলোতে, সাদায় কালোতে, কে না জানে সে ক্ষণভঙ্গুর কালের চাকার নিচে নিঃশেষে ভাঙিয়া হবে চুর। সে বহিয়া এনেছে যে-দান সে করে ক্ষণেকতরে অমরের ভান-- সহসা মুহূর্তে দেয় ফাঁকি, মুঠি-কয় ধূলি রয় বাকি, আর থাকে কালরাত্রি সব-চিহ্ন-ধুয়ে-মুছে-ফেলা। তোমাদের জনতার খেলা রচিল যে পুতুলিরে সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে। এ কথা কল্পনা কর যবে তখন আমার আপন গোপন রূপকার হাসেন কি আঁখিকোণে, সে কথাই ভাবি আজ মনে।
আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়। আমার ভোলার আছে অন্ত, তোমার প্রেমের তো নাই ক্ষয়। দূরে গিয়ে বাড়াই যে ঘুর, সে দূর শুধু আমারি দূর-- তোমার কাছে দূর কভু দূর নয়। আমার প্রাণের কুঁড়ি পাপড়ি নাহি খোলে, তোমার বসন্তবায় নাই কি গো তাই ব'লে? এই খেলাতে আমার সনে হার মানো যে ক্ষণে ক্ষণে, হারের মাঝে আছে তোমার জয়।