নদীর প্রবাহের এক ধারে সামান্য একটা ভাঙা ডাল আটকা পড়েছিল। সেইটেতে ঘোলা জল থেকে পলি ছেঁকে নিতে লাগল। সেইখানে ক্রমে একটা দ্বীপ জমিয়ে তুললে। ভেসে-আসা নানা-কিছু অবান্তর জিনিস দল বাঁধল সেখানে, শৈবাল ঘন হয়ে সেখানে ঠেকল এসে , মাছ পেল আশ্রয়, এক পায়ে বক রইল দাঁড়িয়ে শিকারের লোভে, খানিকটুকু সীমানা নিয়ে একটা অভাবিত দৃশ্য জেগে উঠল--তার সঙ্গে চার দিকের বিশেষ মিল নেই। চৈতালি তেমনি এক-টুকরো কাব্য যা অপ্রত্যাশিত। স্রোত চলছিল যে রূপ নিয়ে অল্প-কিছু বাইরের জিনিসের সঞ্চয় জ'মে ক্ষণকালের জন্যে তার মধ্যে আকস্মিকের আবির্ভাব হল। পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। অল্প তার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার এক তীরে দরিদ্র লোকালয়, গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তূপ; অন্য তীরে বিস্তীর্ণ ফসল-কাটা শস্যখেত ধূ ধূ করছে। কোনো-এক গ্রীষ্মকাল এইখানে আমি বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়বার মতো অবস্থা নয়। বোটের জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁকে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে। মনটা আছে ক্যামেরার চোখ নিয়ে, ছোটো ছোটো ছবির ছায়া ছাপ দিচ্ছে অন্তরে। অল্প পরিধির মধ্যে দেখছি বলেই এত স্পষ্ট করে দেখছি। সেই স্পষ্ট দেখার স্মৃতিকে ভরে রাখছিলুম নিরলংকৃত ভাষায়। অলংকার-প্রয়োগের চেষ্টা জাগে মনে যখন প্রত্যক্ষবোধের স্পষ্টতা সম্বন্ধে সংশয় থাকে। যেটা দেখছি মন যখন বলে, "এটাই যথেষ্ট' তখন তার উপরে রঙ লাগাবার ইচ্ছাই থাকে না। চৈতালীর ভাষা সহজ হয়েছে এইজন্যেই। তুমি যদি বক্ষোমাঝে থাক নিরবধি, তোমার আনন্দমূর্তি নিত্য হেরে যদি এ মুগ্ধ নয়ন মোর,--পরাণ-বল্লভ, তোমার কোমলকান্ত চরণ পল্লব চিরস্পর্শ রেখে দেয় জীবন তরীতে,-- কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে।
বহিয়া হালকা বোঝা চলে যায় দিন তার অবকাশ দেয় না সে কোনো দুশ্চিন্তার! সম্বল কম বটে, আছে বটে ঋণ দায়-- অনুরাগ নেই তবু ভাগ্যের নিন্দায়। পাড়া-প্রতিবেশীদের কটুতম ভাষ্যে নীরব জবাব তার স্মিত ঔদাস্যে জন্ম নেবার কালে পেয়েছিল যৌতুক ভাঙাচোরা জীবনের বিদ্রূপে-- কৌতুক।
এ সংসারে আছে বহু অপরাধ, হেন অপবাদ যখন ঘোষণা কর উচ্চ হতে উষ্ণ উচ্চারণে, ভাবি মনে মনে, ক্রোধের উত্তাপ তার তোমার আপন অহংকার। মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব, কে না জানে চিরকাল আছে সৃষ্টির মর্মের কাছে। না যদি সে রহে বিশ্ব ঘেরি বিরুদ্ধ নির্ঘাতবেগে বাজে না শ্রেষ্ঠের জয়ভেরী। বিধাতার 'পরে মিথ্যা আনিয়ো না অভিযোগ মৃত্যুদুঃখ কর যবে ভোগ; মনে জেনো, মৃত্যুর মূল্যেই করি ক্রয় এ জীবনে দুর্মূল্য যা, অমর্ত যা, যা-কিছু অক্ষয়। ভাঙনের আক্রমণ সৃষ্টিকর্তা মানুষেরে আহ্বান করিছে অনুক্ষণ। দুর্গমের বক্ষে থাকে দয়াহীন শ্রেয়, রুদ্রতীর্থযাত্রীর পাথেয়। বহুভাগ্য সেই জন্মিয়াছি এমন বিশ্বেই নির্দোষ যা নয়। দুঃখ লজ্জা ভয় ছিন্ন সূত্রে জটিল গ্রন্থিতে রচনার সামঞ্জস্য পদে পদে রয়েছে খণ্ডিতে। এই ত্রুটি দেখেছি যখন শুনি নি কি সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী গভীর ক্রন্দন যুগে যুগে উচ্ছ্বসিতে থাকে; দেখি নি কি আর্তচিত্ত উদ্বোধিয়া রাখে মানুষের ইতিবৃত্ত বেদনার নিত্য আন্দোলনে? উৎপীড়িত সেই জাগরণে তন্দ্রাহীন যে-মহিমা যাত্রা করে রাত্রির আঁধারে নমস্কার জানাই তাহারে। নানা নামে আসিছে সে নানা অস্ত্র হাতে কন্টকিত অসম্মান অবাধে দলিয়া পদপাতে-- মরণেরে হানি-- প্রলয়ের পান্থ সেই, রক্ত মোর তাহারে আহ্বানি।