মিথ্যে তুমি গাঁথলে মালা নবীন ফুলে, ভেবেছ কি কণ্ঠে আমার দেবে তুলে? দাও তো ভালোই, কিন্তু জেনো হে নির্মলে, আমার মালা দিয়েছি ভাই সবার গলে। যে-ক'টা ফুল ছিল জমা অর্ঘ্যে মম উদ্দেশেতে সবায় দিনু-- নমো নমঃ। কেউ বা তাঁরা আছেন কোথা কেউ জানে না, কারো বা মুখ ঘোমটা-আড়ে আধেক চেনা। কেউ বা ছিলেন অতীত কালে অবন্তীতে, এখন তাঁরা আছেন শুধু কবির গীতে। সবার তনু সাজিয়ে মাল্যে পরিচ্ছদে কহেন বিধি "তুভ্যমহং সম্প্রদদে'। হৃদয় নিয়ে আজ কি প্রিয়ে হৃদয় দেবে? হায় ললনা, সে প্রার্থনা ব্যর্থ এবে। কোথায় গেছে সেদিন আজি যেদিন মম তরুণ-কালে জীবন ছিল মুকুলসম, সকল শোভা সকল মধু গন্ধ যত বক্ষোমাঝে বন্ধ ছিল বন্দীমত। আজ যে তাহা ছড়িয়ে গেছে অনেক দূরে-- অনেক দেশে, অনেক বেশে, অনেক সুরে। কুড়িয়ে তারে বাঁধতে পারে একটিখানে এমনতরো মোহন-মন্ত্র কেই বা জানে! নিজের মন তো দেবার আশা চুকেই গেছে, পরের মনটি পাবার আশায় রইনু বেঁচে।
ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে; অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক। মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক। যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে। জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল ক'রে শেষে ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে। বারে বারে ঘটি ভ'রে জল তুলে কেউ আনে, কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে। হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে, তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে। গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে। সকল-কর্ম-ভোলা দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্ আঘাটায় যথেচ্ছ ভাঁটায়। মানুষ যখন পাকা ক'রে প্রাচীর তোলে নাই মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই, সেইদিনকার আল্গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ মাঝে মাঝে রক্তে আজও লাগায় মন্ত্রগান। সেইদিনকার যথেচ্ছ-রস আস্বাদনের খোঁজে মিলেছিলেম অবেলাতে অনিয়মের ভোজে। কারো কোনো স্বত্বদাবীর নেই যেখানে চিহ্ন, যেখানে এই ধরাতলের সহজ দাক্ষিণ্য, হালকা সাদা মেঘের নিচে পুরানো সেই ঘাসে, একটা দিনের পরিচিত আমবাগানের পাশে, মাঠের ধারে, অনভ্যাসের সেবার কাজে খেটে কেমন ক'রে কয়টা প্রহর কোথায় গেল কেটে। সমস্ত দিন ডাকল ঘুঘু দুটি। আশে পাশে এঁটোর লোভে কাক এল সব জুটি, গাঁয়ের থেকে কুকুর এল, লড়াই গেল বেধে-- একটা তাদের পালালো তার পরাভবের খেদে। রৌদ্র পড়ে এল ক্রমে, ছায়া পড়ল বেঁকে, ক্লান্ত গোরু গাড়ি টেনে চলেছে হাট থেকে। আবার ধীরে ধীরে নিয়ম-বাঁধা যে-যার ঘরে চলে গেলেম ফিরে। একটা দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি, পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধার রাতি।